ভারতের কুষাণ শাসনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আলোচনা কর
ভারতের কুষাণ শাসনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
মৌর্য যুগের পতন ও গুপ্ত যুগের আবির্ভাবের মধ্যবর্তী কালে ভারতবর্ষে কুষাণ রাজবংশের শাসনকাল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অধ্যায় ৷ আনুমানিক ১৬ খ্রিস্টাব্দে থেকে কুষাণদের শাসন আরম্ভ হয় এবং অনুমান করা হয় যে এই বংশের সর্বশেষ নরপতি বাসুদেব ২৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন ৷ কুষাণদের এই দুই শতাব্দীক শাসনকালে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিধান,শিল্প ও স্থাপত্যের প্রসারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে বহিরবাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সূত্রে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এক গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায় ৷ ঐতিহাসিক রাউলিন সন কুষাণ যুগে যথাযথ গুপ্ত যুগের প্রকৃত মুখবন্ধ স্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন ৷
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অন্ধকার যুগের সূত্রপাত ঘটেছিল ৷ রাজনৈতিক অস্থিরতা অনৈক্য এবং বহি আক্রমণের ফলে ভারতবর্ষের বহুধা বা বিভক্ত হয়ে পড়ে । সেই সময় কুষাণদের অধীনে রাজনৈতিক অধিকার ও বিচ্ছিন্নতা অপশৃতা হয়ে পুনরায় প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও বহির ভারতের মধ্যে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এক ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ৷ কুষাণ সাম্রাজ্যের বিশাল ব্যাপ্তি প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক দিগন্ত খুলে দেয় ৷ ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের বাইরে কুষাণ সাম্রাজ্যের ব্যপ্তির বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ও তাদের সাংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান ঘটে ৷ যার ফলে এক নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব হয় ৷
![]() |
Image sources: Wikipedia |
শাসন কার্যের সুবিধার জন্য কুষাণ সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল ৷ রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ শাসক৷ তিনি ধর্ম, প্রশাসন,বিচার,আইন প্রণয়ন সামরিক প্রশাসন সকল বিষয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ৷ দেশের রাজতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ কুষাণ রাজারা নিজেদের একাধিক উপাধিতে ভূষিত করতেন ৷ প্রথম কদফিস ও দ্বিতীয় কদফিস এর মধ্য এশিয়া অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারে রোম,চীন ও ভারতবর্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের পথ প্রশস্ত হয় । কুষাণ রাজ প্রথম কদফিস রোমান স্বর্ণমুদ্রার অনুকরণে এদেশে প্রথম স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলন করেন ৷
কুষাণ যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজ্য জয়ের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় তা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসারে সহায়তা করেছিল ৷ এ যুগে এশিয়ায়, ইউরোপে বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি বৌদ্ধ ধর্মের সংস্পর্শে এসেছিল ৷ কুষাণ রাজ কনিষ্কের প্রচারের ফলে বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বত ও জাপানে প্রসারিত হয় ৷ চীন ও তিব্বত থেকে বহু পন্ডিতগণ ভারতবর্ষে আসতে থাকেন এবং দেশগুলির সঙ্গে ভারতের আদান প্রদানের পদ প্রশস্ত হয় । কুষাণ যুগে যে বাণিজ্য প্রসারের ফলে দূর প্রাচ্যের দ্বীপগুলিতে ও ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল ৷
কুষাণ রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীলতা ছিলেন ৷ কুষাণ রাজ কনিষ্কের আমলে চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীত অনুষ্ঠিত হয় । এই সময় বৌদ্ধ ধর্ম 'হীনজান 'ও 'মহাজান' এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ৷ মহাজানরা বুদ্ধের মূর্তি পূজার প্রচলন করেন এবং প্রতীকের মাধ্যমে বুদ্ধের উপাসনা করেন ৷ মহাজান বৌদ্ধগন প্রমুখ পালিভাষার পরিবর্তে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সংস্কৃত ভাষার প্রচলন করেন ৷
সংস্কৃতিক দিক থেকে কুষাণ আমল এক নতুন উৎকর্ষের সূচক ৷ কুষান শাসনকাল সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ভাষার উৎকর্ষের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে আছেন । অশ্ব ঘোষের "বুদ্ধচরিত", বসু মিত্রের "মহাবিভাসা শাস্ত্র",নাগার্জুনের "মাধ্যমিক সূত্র", চরকের "সুশ্রুত" প্রভৃতি চিকিৎসা শাস্ত্রের পুস্তক কুষাণ যুগের জ্ঞান ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করেছিল ৷ সংস্কৃত ভাষায় রচিত অশ্ব ঘোষের" বুদ্ধচরিত" একটি মহাকাব্য যেটি বাল্মিকীর রামায়ণের সঙ্গে অতুলনীয় ৷ কুষান রাজ সভার উপরিযউক্ত বিদ্যগণ কুষাণ সাম্রাজ্য কে সমৃদ্ধ করেছিল ৷
কুষাণ যুগের শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এক অভূতপন্ন উৎকর্ষের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল ৷ গান্ধার শিল্পের শিল্পশৈলি এবং ভাস্কর্য ক্রমগ্রিক,রোমান,বৌদ্ধ শিল্পরীতি ও কৌশলের এক অতি অপূর্ব সংমিশ্রণ ৷ গান্ধার শিল্পের বৈশিষ্ট্য গ্রিক ও রোমান শিল্প থেকে সংগৃহীত হলেও এর মানসিক অভিব্যক্তি ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় ৷ গান্ধার শিল্প শৈলির ওপর বিদেশি প্রভাব স্বীকার করে নিয়ে উইল ডুরান্ড, আর.সি. মজুমদার প্রমুখ পন্ডিতগণ মনে করেন যে গ্রীক ও রোমান শিল্পের প্রভাব ছিল গান্ধার শিল্পের উপর ৷ গান্ধার শিল্প ছাড়া ও অমরাবতী, নাগার্জনিকুন্ড, জাবরাপেটাতে ভিন্ন শিল্প রীতি উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ অমরাবতী তে নির্মিত মানস্য মূর্তি আনন্দপূর্ন এবং অতি কঠিন দেহ ভঙ্গিমায় গঠিত ৷ নাগার্জুনীকুণ্ডে আবিষ্কৃত দুটি চৈত্য এবং একটি স্তুপ সম্পূর্ণ ভারতীয় স্থাপত্য শিল্প নিদর্শন ৷
উপসংহারে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতের বহু অঞ্চলে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে কুষাণ যুগ তার বিশিষ্ট ছাপ রেখে গেছে ৷ বহু বিচিত্র জাতি ও মানুষ কুশান সাম্রাজ্যের বসবাস করত ৷ তাদের মধ্যে নানা রীতি প্রথা ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৷ তাই ভৌগোলিক ও জাগতিক দিক থেকে পরস্পরকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন ৷ একদিকে এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অন্যদিকে কুষাণ সম্রাটদের সৎ কাব্য ও সক্রিয় প্রয়াসের ফলে কুষান যুগ প্রাচ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে পেরেছে ৷