ভারত বিভাজনের জন্য মহম্মদ আলি জিন্নাহ কতখানি দায়ী ছিলেন?
ভারত বিভাজন বিষয়টি একটি অতান্ত জটিল ঐতিহাসিক বিষয়। ধর্ম ও রাজনীতি, জাতীয়তাবাদী স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব প্রভৃতির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৩৩ এবং ১৯৩৫ খ্রিঃ চৌধুরী রহমত আলির ছাত্র গোষ্ঠী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পাকিস্তান কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। ইকবাল ১৯৩০ খ্রিঃ মুসলীম লীগের সভাপতি হিসাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিলেন। তাঁকেও পাকিস্তানের জনক বলা হয়। কিন্তু তিনি ভারত বিভাজনের পক্ষে ছিলেন না। তিনি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এমনকি ১৯৪০ খ্রিঃ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব অস্পষ্ট ছিল ।
এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলীম লিগের পাকিস্তান দাবী আদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, ১৬ই আগস্ট ১৯৪৬-এ কলকাতায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, অন্তবর্তীকালীন সরকারে যোগদানের জন্য কংগ্রেসের উপর ব্রিটেনের চাপ সৃষ্টি, লীগের ও জিয়াহের এই সরকারে যোগদানের বিরোধীতা এবং অনিচ্ছা ও সর্বোপরি এই সময় সারা দেশে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ভারত বিভাগকে মেনে নেবার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।
আধুনিক কালে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত ব্যাপারে গবেষিকা আয়েশা জালাল অভিমত প্রকাশ করেন যে ১৯৪০-৪৬ খ্রিঃ মধ্যে জিন্নাহ অথবা মুসলিম লীগ সংহতিপূর্ণভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব তোলেনি। পাকিস্তান প্রস্তাবের অস্পষ্টতা মুসলিম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব জাগাতে সাহায্য করেছিল। ১৯৫৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে প্রায় ৭৪.৭% ভোট পেয়েছিল। এই সাফলা পাকিস্তানের পক্ষে গণভোট হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। এই নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ৮০.৯% ভোট পেয়ে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করেছিল। অন্যান্য দল যেমন- কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
আবার ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬-এর জুনে পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে একটি দলকে ভারতের সংবিধান রচনার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু এই মিশন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৪৬-এর এপ্রিলে দিল্লীতে মুসলিম লীগের আইনসভার সদস্যদের সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানকে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গঠনের দাবী গৃহীত হয়েছিল। অপরদিকে সেই সময় কংগ্রেসের সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন। ক্যাবিনেট মিশন পাকিস্তান দাবী নাকচ করেছিল।
জিন্নাহর দায়িত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত নয়। যদিও তিনি পাকিস্তন গঠনের ব্যাপারে গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন। এই সাথে একথাও ঠিক যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ভূমিকাও ভারতবিভাগের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এরূপ মত প্রকাশ করেছেন যে, হিন্দুরা কেন বুঝতে পারেনি ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের প্রকৃত চরিত্র। তাঁর মতে, এই দুটি ধর্ম প্রকৃতপক্ষে দুটি পৃথক সামাজিক শৃঙ্খলা। সুতরাং জিন্নাহর দায়িত্বের ব্যাপারে একটি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি গ্রহণ করা উচিত।