জায়গিরদারি ব্যবস্থা কী | মুঘল আমলে জায়গিরদারি ব্যবস্থা || 'জাগিরদারী সংকট' কাকে বলে। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য আলোচনা করো।
মুঘল যুগে প্রশাসনের সঙ্গে কৃষি ব্যবস্থার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জায়গীরদারি ব্যবস্থা। এই জায়গিরদারি ব্যবস্থা ১৩শতকে দিল্লির শাসক দ্বারা শুরু হয়েছিল, মধ্যযুগের প্রথম দিকে সামরিক কর্মকর্তাদের তাদের পরিষেবার জন্য পুরস্কৃত করার উপায় হিসাবে। পরবর্তী কালে এটি ১৬ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনে মুঘল সাম্রাজ্য দ্বারা আরও বিকশিত এবং প্রসারিত হয়েছিল। আকবর জায়গিরদারি ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ করার জন্য এবং কৃষকদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন সংসার প্রবর্তন করেন।
সাধারণত 'জায়গির শব্দের অর্থ দখল বা কোন স্থানে অবস্থান।' আরবি শব্দ জায়গির এর প্রয়োগ মুঘল যুগে আকবরই প্রথম সূচনা করে করেন বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন। তবে ডঃ ইরফান হাবিবের মতে সুলতানি যুগে প্রচলিত ইক্তা আর, মুঘল যুগের জায়গির শব্দ দুটির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল
না। তবে জায়গিরদারি ব্যবস্থা কখনই বংশানুক্রমিক
অধিকারভুক্ত হয়নি। সাধারণত মনসবদাররা যখন নগদ বেতনের পরিবর্তে সাম্রাজ্যের একটি অংশের জমি থেকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার অর্জন করতেন তাদের বলা হত জায়গিরদার। আর এই সমস্ত সরকারি জমিকে বলা হত জায়গির। তবে কোন
মনসবদারকে জায়গির দেওয়া হবে তা মুঘল নিজে ঠিক করতেন। সম্রাট
জায়গিরদার দের জায়গীরের উপর অধিকার কত দিনের জন্য তাও নির্দিষ্ট ছিল না। বেতনের পরিবর্তে যে জায়গির লাভ করতেন তা কেবল ভোগ দখল করতে পারতেন, কাউকে বিক্রি করতে পারতেন না। তাছাড়া জায়গির বংশানুক্রমিকভাবে পাওয়া যেত না, সম্রাট ইচ্ছামত কোন জায়গিরদারকে অন্য অঞ্চলে বদলি করতে পারতেন। কোনো জমি থেকে কতটা রাজস্ব পাওয়া যাবে সরকার তার একটা হিসাব করতেন, তাকে বলা হত 'জমা' এবং সেই এলাকা থেকে প্রকৃত রাজস্ব সংগ্রহের পরিমানকে বলা হত 'হাসিল'। আর এই 'জমা' ও 'হাসিলের' মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি জায়গিরদারি ব্যবস্থার সংকট তৈরি করে।
জায়গিরদারী ব্যবস্থায় জায়গিরের বিভিন্ন ধরনের রকমভেদ ছিল।
ওয়াতেন জায়গিরঃ দেশীয় জমিদার বা সামন্তরা মুঘলদের অধীনে চাকরি করার সুবাদে বংশানুক্রমিকভাবে যে জমি ভোগ দখল করতো।
তনখা জায়গিরঃ যারা বেতনের সমপরিমাণ ভূমিরাজস্বের অনুপাতে জায়গীর পেত তাদের জায়গীর কে তনখা জায়গির বলা হতো।
মসরুৎ জায়গিরঃ আবার কোনো পদাধিকারী কেনিয়োগের সময়ে নির্দিষ্ট শর্ত অনুসারে যে জায়গির দেওয়া হত, তাকে বলা হত 'মসরুৎ জায়গির'।
জায়গিরদাররা বিভিন্ন অঞ্চলে মুঘল সম্রাটের হয়ে
রাজস্ব আদায়ের কাজ করত। এই কাজের জন্য তারা আমিল, গোমস্তা, শিকদার প্রভৃতি কর্মচারীদের
নিয়োগ করত। কিন্তু এই ধরনের কর্মচারীরা জায়গিরদারের নির্দিষ্ট করা রাজস্বের অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করত। আবার জায়গিরদার শ্রেণি সব সময় নিজেরা রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব আদায় করত না। তারা ইজারাদার নিয়োগ করে তাদের হাতে রাজস্ব কর্মচারীরা জায়গিরদারের নির্দিষ্ট করা রাজস্বের অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করত। আবার জায়গিরদার শ্রেণি সব সময় নিজেরা রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব আদায় করত না। ফলে ইজারাদাররা কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি সম্ভব রাজস্ব জোর করে আদায় করত।
মুঘল সম্রাটরা জায়গিরদারদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চৌধুরি ও কানুনগো নামে দুই ধরনের কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। তা ছাড়া প্রজারা সরাসরি জায়গিরদারের বিরুদ্ধে সম্রাটকে ক্ষোভ জানাতে পারত। অবশ্য মুঘল সম্রাটরা অনেক ক্ষেত্রে জায়গিরদারদের বদলির ব্যবস্থা করলেও সব সময় কঠোর হতেন না। কেন না জায়গিরদার শ্রেণি সাধারণভাবে মুঘল সম্রাটদের বিরোধী ছিল না। সম্রাট শাহজাহান জায়গিরদারি ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং এই ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলাপূর্ণ . করার জন্য প্রথমে প্রতিটি মহলে একজন করে আমীন নিযুক্ত করেন ও ক্রোড়ীদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। তবে জায়গিরদাররা যখন থেকে তাদের জায়গির ইজারা দিতে শুরু করেন তখন থেকেই কৃষক শোষণ বৃদ্ধি পায় এবং ঘন ঘন কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।
ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র এই জায়গিরদারি সংকটকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ বলে উল্লেখ করেছেন ।