জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট কী ছিল। এই ঘটনার গুরুত্ব আলোচনা করো। অথবা, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট কি ছিল। এই ঘটনার গুরুত্ব আলোচনা করো। অথবা, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি কি ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল। অথবা, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট কী ছিল। এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের পটভূমি
ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তীব্র দমনমূলক রাওলাট আইন পাশ করলে এই আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে প্রতিবাদ আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পাঞ্জাবে রাওলাট-বিরোধী আন্দোলনের সর্বাধি ভাগযোগ্য ও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল ১৩ এপ্রিল (১৯১৯ জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে একটি শান্তিপূর্ণ জমায়েতে ইংরেজ উক্ত রেশের নির্বিচার গুলিচালনা এবং এর ফলে অন্তত ১০০০ মানুষের পড়া। এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের পটভূমি নীচে উল্লেখ করা হল-
জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সমনা ও অর্থ সংগ্রহ, 'গদর' বিদ্রোহ প্রতিরোধ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে সরকার লোকয়ারে তীব্র দমনপীড়ন চালালে পাঞ্জাব ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের পীয় বেড়াত সেনাদের সমাবেশে এই ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় প্রিমি রোবের গভর্নর মাইকেল ও' ডায়ারের অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে চলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে।
ভারতীয়দের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ এবং আন্দোলন কঠোর হাতে দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ বাড়ি প্রিস্টাব্দে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী রাওলাট আইন প্রবর্তন করে। এই নিষ্ঠুর মনমূলক আইনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে। এই আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাব বারুদের স্তূপে পরিণত হয়।
'পিপল্স কমিটি' নামে একটি গণসংগঠন নাহার ও অমৃতসরে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে হেলে। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে মূল আন্দোলন ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে মদত দেওয়ার অভিযোগে সমকার অমৃতসরের দুই নেতা ড. সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে (১০ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রি.) গ্রেপ্তার করে। ফলে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এদিকে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোরে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। উত্তেজিত জনতা সরকারি অফিস-আদালত, টেলিগ্রাফ লাইন ও অন্যান্য সরকারি সম্পত্তিতে আক্রমণ চালায়।
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও' ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসর শহরের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। এই বাহিনী অমৃতসরে সামরিক আইন জারি করে ১১ এপ্রিল শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াঃ
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ঘটনায় ভারতবাসীর কাছে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্নরূপটি প্রকাশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায় গুলি চালানোর ঘটনাকে সমর্থন করে। ভারত-সচিব মন্টেগু এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে 'নিবারণমূলক হত্যাকাণ্ড' বলে অভিহিত করেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারতীয়রা এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে সারা ভারত ক্ষোভ, ক্রোধ ও ঘৃণায় ফেটে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, "এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।" জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক ও ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন। গান্ধিজিও ব্রিটিশদের দেওয়া 'কাইজার-ই-হিন্দ' উপাধি ত্যাগ করেন। একসময় ব্রিটিশ জালি শাসনকে 'ঈশ্বরের আশীর্বাদ' মনে করা গান্ধিজি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, "এই শয়তান OPIC [B] সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।"
জাতীয় কংগ্রেস জালিয়ানওয়ালা-বাগের হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করে। কংগ্রেস নেতা সি. এফ. এন্ড্রজ এ এই ঘটনাকে 'কসাইখানার গণহত্যার' (It was a massacre, a butchery) সমতুল্য বলে নিন্দা করেছেন। ব্রিটিশ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে কংগ্রেস নিজের উদ্যোগে হত্যাকান্ডের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ তার রিপোর্টে হত্যাকাণ্ডের জন্য ডায়ারকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে শাস্তিদানের সুপারিশ করে।