১৫২৬-১৫৫৬ খ্রিঃ পর্যন্ত মোগল আফগান দ্বন্দ্বের বিবরণ দাও? বা, ১৫২৬ থেকে ১৫৫৬-এর মধ্যে উত্তর ভারতে আধিপত্য রক্ষার ক্ষেত্রে মুঘল-আফগান দ্বন্দ্বের বিবরণ দাও।
১৫২৬-১৫৫৬ খ্রিঃ পর্যন্ত মোগল আফগান দ্বন্দ্বের বিবরণ দাও?
সমাজ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আমরা সর্বদা তা লক্ষ্য করে এসেছি । ভারতবর্ষের মধ্যযুগের সূচনা পর্বেও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি ৷ 1526 থেকে 1556 খ্রিস্টাব্দকে ভারতীয় ইতিহাসে মুঘল-আফগান দ্বন্দ্বের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য এই দুই শক্তি মুঘল-আফগান জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ।
ষোড়শ শতকের শুরুতে উত্তর ভারতের অনেক অঞ্চল আফগান কর্তৃত্ব দ্বারা শাসিত হয়েছিল । সুলতান ইব্রাহিম লোদি এই আফগান সামন্তদেরকে বিভিন্নভাবে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি কখনই তাদের পুরোপুরি দমন করতে সক্ষম হননি । 1526 খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদি মুঘল সম্রাট বাবরের দ্বারা পরাজিত হলেও এক দীর্ঘ সময় ধরে মুঘল কেন্দ্রীয় শক্তিকে আফগানদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে থাকতে হয়েছিল । এই যুদ্ধ চলেছিল মোটামুটি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৷
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মোগলআফগান দ্বন্দ্ব সম্পর্কে জানার জন্য আমরা যে সকল গ্রন্থ গুলির ওপর নির্ভর করে থাকি সেগুলি হল"তুজুক-ই-জাহাজিরা", "আইন ই আকবরী", "আকবর নামা" প্রভৃতি ৷ এছাড়াও অন্যান্য সমসাময়িক ইতিহাসবিদ এবং পন্ডিত যেমন স্যার এলফিনস্টোন, শ্রীবাস্তব, লেনপুল, প্রভৃতি প্রমুখদের গ্রন্থ গুলি আমাদের সত্যিই আমাদের সাহায্য করে ।
ভারতে মুঘল মোগল আফগান দ্বন্দ্বের সূচনা হয় মূলত বাবরের হাত ধরে ১৫২৬ খ্রি ২৯ নভেম্বর বাবর ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে দৌলত খাঁকে পরাজিত করার পর বাবর প্রথমে পাঞ্জাব দখল করেন । তারপর, 21 এপ্রিল, 1526 খ্রিস্টাব্দে, বাবর কয়েকটি যোদ্ধা নিয়ে বিশাল সৈন্যধর সুলতান ইয়াহিম লেদির সাথে প্রথম পানিপথ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । এই লড়াইয়ে, বাবার রুমি কৌশল ব্যবহার করে ইব্রাহিম লোদিকে সহজেই পরাজিত করেন এবং বাবর "বাদশাহ" উপাধি গ্রহণ করে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ৷
তারপর, 27 মার্চ, 1527 খ্রিস্টাব্দে, খানুয়ার যুদ্ধে, ইব্রাহিম লোদীর ভাই মামুদ লোদী এবং কয়েকজন রাজপুত্র বাবরের সাথে লড়াই করার জন্য একত্রিত হন । বাবর এই যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আফগান ও রাজপুত বাহিনীকে পরাজিত করে দিল্লিতে মুঘল কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করেন । বাংলা ও বিহারের আফগানরা ইব্রাহিম লোদির ভাই মামুদ লোদির নেতৃত্বে বিহারের শের খাঁ এবং বাংলার নসরত শাহের সাথে একত্রে একটি শক্তি জোট প্রতিষ্ঠা করে । 1529 খ্রিস্টাব্দে মে ঘার্ঘরার যুদ্ধে বাবর এই সৈন্যদের জোটকে পরাজিত করেন।
বাবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র হুমায়ুন দিল্লিতে মুঘল সিংহাসন গ্রহণ করেন এবং তার সিংহাসনে বসার পর থেকেই মুঘল আফগান দ্বন্দ্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয় । হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের নায়ক ছিলেন শের খাঁ । শেরশাহের সৈন্য বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে হুমায়ুন ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে দীরার যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং জয় লাভ করেন ৷
লোড দুর্গে আপ গান অধিষ্ঠিত শের খা বিহারের সিংহাসন দখল করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করলে বক্সারের কাছে চৌসা গ্রামে হুমায়ুনের সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয় । ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুন চৌসারের যুদ্ধে শের খান জয়লাভ করেন । বাংলা, বিহার, জৌনপুর এবং কনৌজ আফগান শাসন এই বছরে প্রতিষ্ঠিত হয় । এরপর ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কনৌজের নিকটবর্তী বিল্বগ্রাম নামক স্থানে হুমায়ুন ও শেরশাহ যুদ্ধে লিপ্ত হন । এই যুদ্ধের পর, শের শাহ দিল্লির সিংহাসনে আফগান নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন, হুমায়ুনকে পালাতে বাধ্য করেন ।
তবুও শেরশাহের বিশাল দক্ষতা দক্ষতার সঙ্গে ভারতবর্ষের যে বিশাল রাজনীতিতে মুঘল শক্তির অবসান ঘটিয়ে যে নতুন শক্তির সূচনা করেছিলেন তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । কারণ ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র ইসলাম শাহ ও আদিল সাহের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে তীব্র বিরোধিতা দেখা দেয়। এইরকম অভ্যন্তরীণ বিবাদের সুযোগ দেখে আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমুর মুঘল সম্রাট ও তার অভিভাবক বৈরাম খাকে মিলিতভাবে দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে অবর্তীন হয় । এই লড়ায়ে আকবর হিমুকে পরাজিত করে এবং দিল্লিতে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, এইভাবেই দীর্ঘ মুঘল আফগান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে ।
মধু যুক্ত ফুলের কুঁড়ি সংগ্রহ করতে যেমন বহু কীটপতঙ্গ যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভাবেই ভারতবর্ষের দিল্লির সিংহাসনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন শক্তি সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দ্বন্দ্বের মাধ্যমে তারা মধ্যযুগীয় ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশকে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। এর একটি বাস্তব উদাহরণ ছিল মুঘল-আফগান দ্বন্ধ ।